বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির এ আসরে স্বাগতিক দেশ পাকিস্তান। অথচ মাঠের বাস্তবতা বলছে অন্য কথা—পাকিস্তানকে নিজ দেশ ছেড়ে খেলতে হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, যেখানে ভারত একই মাঠ ও একই কন্ডিশনে থেকে তুলনামূলকভাবে বহুগুণ বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেইন থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার রেসি ফন ডার ডুসেন—অনেকেই এটি নিয়ে সরব হয়েছেন। এই বিশেষ সুবিধার জের ধরেই ক্রিকেটবিশ্বে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মূল আয়োজক পাকিস্তান, তবে ভারতের আপত্তির কারণে ‘হাইব্রিড পদ্ধতি’তে টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অর্থাৎ পাকিস্তান বাদে ভারতের ম্যাচগুলো দুবাইয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে ভারত কোনো ভ্রমণদূর্ভোগ ছাড়াই একই ভেন্যুতে খেলতে পারছে। অপরদিকে, পাকিস্তানকে হোম-অ্যাডভান্টেজ থেকে বঞ্চিত হয়ে সময় ও পরিবেশ বদলে বিভিন্ন স্টেডিয়ামে খেলতে হচ্ছে—যার মধ্যে কিছু ম্যাচের জন্য আরব আমিরাতও যাতায়াত করতে হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দলগুলোও ভবিষ্যতে সেমিফাইনাল বা ফাইনালে উঠলে কোথায় খেলবে, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানে না। একমাত্র ভারতই আগে থেকে নিশ্চিত হয়ে আছে যে তারা দুবাইয়েই সব ম্যাচ খেলবে—সেখানেই সেমিফাইনাল ও ফাইনালেও অংশ নেবে। এভাবে এক জায়গায় টানা থাকার ফলে ভারত একই হোটেল, একই অনুশীলন-সুবিধা এবং একই উইকেটে খেলার সুবাদে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে।
ক’দিন আগে নাসের হুসেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন যে, ‘স্বাগতিক পাকিস্তান, অথচ ঘরের মাঠের সুবিধাটা নিচ্ছে ভারত।’ তিনি এ-ও যোগ করেন, প্রতিপক্ষদের চেয়ে ভারত অনেক কম ভ্রমণের ধকল পোহাচ্ছে এবং একই মাঠে বারবার খেলে কন্ডিশনের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সুবাদে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান রেসি ফন ডার ডুসেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফির এ আয়োজন নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, ভারতের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে এটি বুঝতে ‘রকেটবিজ্ঞানী’ হওয়ার দরকার নেই। তিনি সরাসরি বলেছেন, “একই উইকেট ও একই পরিবেশে খেললে সেই দলের জন্য তা অবশ্যই বড় সুবিধা।”
ডুসেন আরও উল্লেখ করেন যে, এক জায়গায় অটল থাকার চাপও ভারতকে নিতে হবে। কারণ, ইতিমধ্যে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, সেমিফাইনাল বা ফাইনালে যদি ফল প্রত্যাশামতো না আসে, তবে সমালোচনার মুখে পড়বে ভারতীয় দল। তবু ওই পরিচিত পরিবেশে অনুশীলন ও ম্যাচ খেলার বাড়তি অনুকূল অবস্থান ভারতকে স্পষ্টভাবেই এগিয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করেন তিনি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তা শঙ্কা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। আইসিসি এ কারণেই প্রথমবারের মতো ‘হাইব্রিড পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে এক ভাগে পাকিস্তানে ও অন্য ভাগে দুবাইয়ে ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত বরাবরই পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে অনীহা দেখিয়েছে। ফলে স্বাগতিক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানকে নিজেদের “হোম-গ্রাউন্ড” ব্যবহার করার স্বাধীনতা পুরোপুরি দেওয়া হয়নি।
এ ব্যবস্থা ভারতকে দিয়েছে বিশাল এক বাড়তি সুযোগ—যেখানে একই শহরে থেকে, একই পরিবেশে, একই উইকেট শেয়ার করে সবগুলো গ্রুপ ম্যাচ খেলতে পারছে তারা। সেমিফাইনাল আর ফাইনালেও একই মাঠ এবং পরিচিত পরিস্থিতি থাকবে তাদের পক্ষেই। অন্যদিকে পাকিস্তান সহ বাকি দলগুলোকে বিভিন্ন ভেন্যু, ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। স্বাগতিক হয়েও পাকিস্তান দলের এখন বড় চ্যালেঞ্জ: দেশের মাঠে দর্শক ও পরিবেশের পূর্ণ সুবিধা না পাওয়া। পাকিস্তানের কোচ আকিব জাভেদ বলেছেন, “ভারত যখন একই উইকেটে নিয়মিত খেলার সুফল পাবে, আমরা তখন তাদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে। অবশ্য আমরা পরাজয়ের কারণ এটিকেই দাঁড় করাইনি। কারণ, খেলার মাঠে সামগ্রিক পারফরম্যান্সই আসল।”
অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, যিনি বর্তমানে চোটের কারণে মাঠের বাইরে, তিনিও ভারতকে “অনেক বড় সুবিধা” পেতে দেখছেন। ইয়াহু স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কামিন্স খোলাখুলিভাবে বলেন, “টুর্নামেন্ট দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ভারত সবদিক দিয়ে প্রস্তুত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়ে যাচ্ছে। অন্যরা কিন্তু বারবার স্থানান্তরিত হচ্ছে।” দক্ষিণ আফ্রিকা এখনো সেমিফাইনালে খেলার পথে রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে অন্য ম্যাচগুলোর ফলের ওপর। যেমন আজ অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জিতলে প্রোটিয়াদের সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাবে। কিন্তু যদি ভিন্ন কোনো ফল হয়, তাহলে পরের দিন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মরিয়া লড়াই করতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ডুসেনের ভাষ্য, “আমরা এখনো জানি না সেমিফাইনালে উঠলেও কোথায় খেলব, পাকিস্তানে নাকি দুবাইয়ে। কিন্তু ভারত আগে থেকেই নিশ্চিত—তারা দুবাইতেই খেলবে। সেমিফাইনাল হোক বা ফাইনাল, একই উইকেট, একই কন্ডিশন তাদের ভালোভাবে মুখস্থ।”
প্রশ্ন ওঠে, পাকিস্তান স্বাগতিক হলেও কার্যত ঘরের মাঠের সুবিধা কি তারা পাচ্ছে? উত্তরটা বরং নেতিবাচক। পাকিস্তানের পক্ষে এর একমাত্র ভালো দিক হতে পারে স্বদেশি দর্শকের উচ্ছ্বাস, তবে সেটিও সীমিত; কারণ, বড় ম্যাচগুলো—বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে—দুবাইতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক দ্বৈরথে উপমহাদেশের ভক্তরা মাঠ ভরিয়ে তুললেও পাকিস্তানের প্রকৃত হোম-গ্রাউন্ডের উত্তেজনা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত বরাবরই একটি শক্তিশালী দল, বড় মঞ্চে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের মতো খেলোয়াড় তাদের স্কোয়াডে থাকে। হাইব্রিড পদ্ধতি মেনে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে বাড়তি সুবিধাটি ভারত চাইলে বাড়তি আত্মবিশ্বাস হিসেবেও নিতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষদের কণ্ঠে স্পষ্টতই এক ধরণের খেদ ধ্বনিত হচ্ছে।
অনেকে বলছেন, পরিচিত পরিবেশে এই বাড়তি সুবিধা পেয়েও যদি ভারত শিরোপা না জিতে, তবে সেটি তাদের জন্য বড় পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার সাফল্য পেলে সমালোচকেরা বলতে পারে, “যে বাড়তি সুবিধা ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটার যথাযথ মূল্য তারা আদায় করেছে।” টুইটার থেকে শুরু করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ক্রিকেটপ্রেমীরা এই আয়োজন নিয়ে নানা মতামত দিচ্ছেন। কেউ কেউ জোর গলায় দাবি করছেন, আইসিসিকে ভারতের প্রভাবমুক্ত হতে হবে। আবার অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনা এবং উভয় দেশের মধ্যকার পুরোনো উত্তেজনার ফলেই এই সমঝোতা করতে হয়েছে আইসিসিকে। তবে তাতে খেলার নিরপেক্ষতা ঠিক কতটা বজায় থাকল, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।