নবপ্রবর্তিত রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) সম্প্রতি দেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে গঠিত এই দলের মূল লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। এ উদ্দেশ্যে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনাকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দলের আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির আনুষ্ঠানিক যাত্রা ঘোষণা করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ভাবনা
নতুন এই রাজনৈতিক শক্তির পেছনে রয়েছে সদ্যঘটা ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় আসীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানোর পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি মৌলিক পরিবর্তন—কেবলমাত্র অন্য কোনো সরকারকে ক্ষমতায় বসানো নয়। নাহিদ ইসলামের ভাষায়, দেশে যে রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার মূল প্রেরণা ছিল রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে জনঅধিকারভিত্তিক একটি কাঠামো তৈরি করা। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ধারণা ঠিক সেখান থেকেই জন্ম নেয়। এই নতুন প্রজাতন্ত্র এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক চর্চা ও সামাজিক সাম্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা হবে।
নাহিদ ইসলাম তাঁর ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিকের মূল ভিত গড়ে তুলতে একটি গণপরিষদ নির্বাচন অপরিহার্য। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের ফাঁকফোকর দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পুণরায় আবির্ভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যেতে পারে। তাই, সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক পথে স্থায়ীভাবে সংহত করা এনসিপির অন্যতম মিশন। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধানের এ পুনর্গঠন কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারকে ধারণ করে এই নতুন রাষ্ট্রের কাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শন
জাতীয় নাগরিক পার্টি নিজেদেরকে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে তুলে ধরেছে। তারা মনে করে, গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমস্ত স্তরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার যে কাঠামোগত সংকট সৃষ্টি করেছে, তা দূর করতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবার বা গোষ্ঠীর আধিপত্য যাতে সমাজের প্রতিটি খাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য এনসিপি “মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা”র বিষয়কে বড় করে দেখছে। এ ছাড়া, ঐক্যের মাধ্যমে আগামীর পথচলা এবং প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব পরিত্যাগ করে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিশ্রুতিও দলটি দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্ত কাঠামোতে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এনসিপির এই ঘোষণায় স্পষ্ট, তারা কোনও একক সম্প্রদায় বা শ্রেণির অধিকারকেই কেবল বড় করে দেখছে না; বরং সার্বজনীন মুক্তি ও সমৃদ্ধির দিকেই তাদের সমস্ত কর্মপন্থা নিবেদিত রাখতে চায়।
সমাজ, সংস্কৃতি ও জাতীয় প্রতিরক্ষা
নতুন প্রজাতন্ত্রের রূপরেখায় দলটি বিশেষভাবে জোর দিয়েছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র সুরক্ষার ওপর। নাহিদ ইসলাম তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অপরিহার্য। কিন্তু এর পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে কেন্দ্রে রেখে কাজ করতে হবে।
এর ফলে, একদিকে যেমন দেশ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকির মুখে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়াতে পারবে, অন্যদিকে সবার জন্য সুযোগের সমান নিশ্চয়তা বিধান করে নাগরিকদের মনে আস্থা ফিরে আসবে। বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও সংস্কৃতি নিয়ে যে বহুত্ববাদী বাংলাদেশ, সেখানেও কেউ যেন ‘অবাঞ্ছিত’ বা ‘অপরায়ণ’ হিসেবে চিহ্নিত না হয়, তা নিশ্চিত করাই সেকেন্ড রিপাবলিকের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানান এনসিপির নেতারা।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা
জাতীয় নাগরিক পার্টির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা একাধিক দিক থেকে অভিনব। তাঁরা চান কৃষি, সেবা ও উৎপাদন খাতকে সমন্বিত করে এমন এক অর্থনীতি গড়ে তুলতে, যা হবে স্বনির্ভর, আয়-বৈষম্যহীন এবং পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল। এটি বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের সুষম পুনর্বণ্টন, সিন্ডিকেট ভাঙা, স্বচ্ছ নিয়ম-কানুন তৈরি করা ও ভোক্তা-সুরক্ষা জোরদার করার মতো পদক্ষেপকে তারা প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনায় রেখেছে।
নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেন, সম্পদ যেন কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়—সেই বিষয়টিকে দলটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। পাশাপাশি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে জোর দিয়ে একটি উদ্ভাবনী সংস্কৃতি চালু করার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতাও তাদের এজেন্ডায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার ও বহুত্ববাদ
সেকেন্ড রিপাবলিকের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে সমাজের পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনা। এনসিপির ভাষায়, “সমাজের যে অংশ এত দিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বাইরে ছিল, তারাই হবে আসন্ন পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।” সবার সমান অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা মাত্র রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং বাস্তবায়নযোগ্য সংবিধান কাঠামোর মধ্য দিয়ে তা দৃঢ় করতে চায় তাঁরা।
নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিকে নাগরিকদের কোনও অংশকে বাদ দেওয়া হবে না। সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি, সবার কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা ও জীবনের প্রতিটি স্তরে মানুষ যেন স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারে—এই প্রত্যয়ই তাঁদের রাজনীতির মূলমন্ত্র।
বৈদেশিক প্রভাব ও স্বদেশ-প্রেম
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশে বাইরের রাষ্ট্র বা শক্তির মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রবণতা কিছুটা প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিল বলে ধারণা করেন এনসিপির নেতারা। অতীতে ভারতপন্থী কিংবা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির প্রভাব এখানে নানা সময়ে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু এনসিপি জোর দিয়ে বলেছে, তারা সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখবে। রাষ্ট্রের আর্থিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতেও স্বনির্ভরতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে বলে দলটি নিশ্চিত করেছে।
ঐক্যবদ্ধ অগ্রযাত্রার ডাক
জাতীয় নাগরিক পার্টির উদ্ভব মূলত ঐক্যের ডাক দিয়েই। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবিচারের পর দেশের মানুষ এখন এমন একটি রাজনৈতিক শক্তির অপেক্ষায় আছে, যারা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমমর্যাদার ধারক-বাহক হবে। এক্ষেত্রে নতুন সংবিধানের মধ্য দিয়ে সেকেন্ড রিপাবলিক গড়ে তোলার যে বক্তব্য এনসিপি তুলে ধরেছে, তা জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত বলে মনে করছে দলের সমর্থকেরা।
নাহিদ ইসলাম শেষ বক্তৃতায় বলেছেন, “আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ—এগুলো আর শুধু স্বপ্ন নয়। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই ফলপ্রসূ হবে।” একই সঙ্গে তিনি সকলকে আহ্বান জানান, ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
গণতান্ত্রিক চর্চাকে টেকসই করা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে পুনরায় গড়ে তোলা এবং সব ধরনের বৈষম্য নিরসন করে একটি সমৃদ্ধ, বহুমুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলা—এই সব কটি বিষয়ই জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই দলটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর দেশকে নতুন করে বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা এবং সেই পথে প্রথম বড় পদক্ষেপ গণপরিষদ নির্বাচন ও একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন।
সমর্থকেরা আশা করছেন, এনসিপির এই দৃঢ়, সাহসী ও সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। সময়ই বলে দেবে, এই নবযাত্রা কতটা ফলপ্রসূ হয়। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, গণতন্ত্র ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সেকেন্ড রিপাবলিকের ধারণা দেশে এক নতুন রাজনীতিক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এনসিপি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।