গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের হাত ধরে রাজনীতিতে এবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। দীর্ঘদিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পর তরুণ নেতৃত্বের এগিয়ে আসা অনেকের কাছেই আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বর্ণাঢ্য এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দলটি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে। অনুষ্ঠানেই ঘোষিত হয় দলের আহ্বায়ক কমিটির নাম-পরিচয়, যা নতুন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রারম্ভিক দলিল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুক্রবারের এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহত সংগ্রামী তরুণ-তরুণীসহ বহু সমর্থক। তাঁদের চোখে-মুখে ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য নতুন স্বপ্নের আভাস। অনুষ্ঠানে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন মীম আক্তার, যিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ ইসমাঈল হোসেন রাব্বির বোন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে নতুন রাজনৈতিক দর্শন ও নেতৃত্বের চাহিদা তীব্র হয়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষের জীবনমানের অবনতি, বৈষম্য ও ন্যায়বিচারের অভাবে অতিষ্ঠ তরুণ প্রজন্ম নিজেরাই নেতৃত্বে আসার উদ্যোগ নেয়। শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই ঐতিহাসিক পর্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি যেন সময়ের দাবি মেনেই আত্মপ্রকাশ করেছে।
নতুন এই দলটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একীভূত করতে চায় এবং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অঙ্গীকার নিয়েছে। দলটির দুই প্রধান শীর্ষনেতা—আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন—অনুষ্ঠানে তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে গণ–অভ্যুত্থানের চেতনার ধারাবাহিকতা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার আভাস দিয়েছেন।
মূল নেতৃত্ব: আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব
অনুষ্ঠানে দলের আহ্বায়ক হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয় নাহিদ ইসলামকে এবং সদস্যসচিব হিসেবে আখতার হোসেন দায়িত্ব পান। তাঁরা দুজনই দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
নাহিদ ইসলাম: দলের প্রধান হিসেবে তিনি রাজনৈতিক কৌশল ও দিকনির্দেশনা দেবেন।
আখতার হোসেন: সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রশাসনিক বিষয়ে তদারকি করবেন।
দলের ঘোষিত কাঠামো অনুযায়ী, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের অধীনে বিভিন্ন পদ-পদবি ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। এতে দলের কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
আহ্বায়ক কমিটির কাঠামো: গুরুত্বপূর্ণ পদ ও সদস্য
দলের ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটিতে রয়েছে একাধিক স্তরের পদবী—জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব, যুগ্ম সদস্যসচিব সহ আরও নানা ভূমিকায় নেতৃবৃন্দ নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে মুখ্য সংগঠক ও যুগ্ম মুখ্য সংগঠকদের মাধ্যমে সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।
শীর্ষ পদগুলো
পদবি | নাম |
---|---|
আহ্বায়ক | নাহিদ ইসলাম |
সদস্যসচিব | আখতার হোসেন |
জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক | সামান্তা শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব |
জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব | তাসনিম জারা, নাহিদা সারওয়ার নিভা |
এই তালিকা প্রাথমিকভাবে ঘোষিত; পরবর্তীতে কার্যকরী কমিটি বিস্তৃত হতে পারে এবং নতুন সদস্য যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুগ্ম আহ্বায়কের তালিকা
যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আছেন মোট ১৬ জন, যাঁদের প্রত্যেকেই তরুণ সমাজে বেশ পরিচিত মুখ বা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। এই সদস্যরা হলেন:
- নুসরাত তাবাসসুম
- মনিরা শারমিন
- মাহবুব আলম
- সারোয়ার তুষার
- মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন
- তাজনুভা জাবীন
- সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া
- আতিক মুজাহিদ
- আশরাফ উদ্দিন মাহাদী
- অর্পিতা শ্যামা দেব
- তানজিল মাহমুদ
- অনিক রায়
- খালেদ সাইফুল্লাহ
- জাবেদ রাসিন
- এহতেশাম হক
- হাসান আলী
যুগ্ম সদস্যসচিবের তালিকা
যুগ্ম সদস্যসচিব পদে রয়েছেন ৩২ জন, যাঁদের মধ্যে:
1. আবদুল্লাহ আল আমিন
2. আরিফ সোহেল
3. রশিদুল ইসলাম রিফাত
4. মাহিন সরকার
5. মো. নিজাম উদ্দিন
6. আকরাম হুসেইন
7. এস এম সাইফ মোস্তাফিজ
8. সালেহ উদ্দিন সিফাত (দপ্তরে সংযুক্ত)
9. আলাউদ্দীন মোহাম্মদ
10. ফরিদ উদ্দিন
11. মো. ফারহাদ আলম ভূঁইয়া
12. মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া
13. লুৎফর রহমান
14. মো. মঈনুল ইসলাম (তুহিন)
15. মুশফিক উস সালেহীন
16. জাহিদুল ইসলাম
17. জহিরুল ইসলাম মুসা
18. হুমায়রা নূর
19. মোশফিকুর রহমান জোহান
20. মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান
21. সাগুফতা বুশরা মিশমা
22. আহনাফ সাইদ খান
23. আবু সাঈদ মোহাম্মদ সুজা উদ্দিন
24. মীর আরশাদুল হক
25. ফয়সাল মাহমুদ শান্ত
26. তারেক রেজা
27. মশিউর রহমান
28. জয়নাল আবেদীন শিশির
29. মুনতাসির রহমান
30. গাজী সালাউদ্দীন তানভীর
31. তামিম আহমেদ
32. তাহসীন রিয়াজ
আঞ্চলিক দায়িত্ব: দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমন্বিতভাবে দলীয় কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল ভাগ করে মুখ্য সংগঠক, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও সংগঠকের পদ তৈরি করা হয়েছে। এভাবে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তুলে, জনগণের মধ্যে দলটির আদর্শ ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
দক্ষিণাঞ্চল
- মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল): হাসনাত আবদুল্লাহ
- যুগ্ম মুখ্য সংগঠক: মোহাম্মদ আতাউল্লা, মাহমুদা মিতু, মোল্লা রহমাতুল্লাহ, এস এম শাহরিয়ার, জোবারের আরিফ
দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক পদে দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন ২৬ জন, এঁদের মধ্যে আছেন:
আকরাম হোসাইন রাজ, হামজা মাহবুব, ওয়াহিদুজ্জামান, আসাদ বিন রনি, মোহাম্মদ রাকিব, আরমান হোসাইন, মো. রাসেল আহমেদ, মনজিলা ঝুমা, শওকত আলী, আশরাফুল ইসলাম সুমন, মুনতাসীর মাহমুদ, মিনহাজুল আবেদীন, সাকিব শাহরিয়ার, মেজবাহ কামাল মুন্না, সাকিল আহমাদ, ইমন সৈয়দ, আজিজুর রহমান রিজভী, আব্দুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ, নয়ন আহমেদ, কাউছার হাবিব, রকিব মাসুদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন ফয়সাল, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জিহান, সানাউল্লাহ খান, আরিফুল ইসলাম ইত্যাদি।
উত্তরাঞ্চল
- মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল): সারজিস আলম
- যুগ্ম মুখ্য সংগঠক: সাইফুল্লাহ হায়দার, আলী নাছের খান, সাকিব মাহদী, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, সাদিয়া ফারজানা দিনা, অলিক মৃ, হানিফ খান সজীব
উত্তরাঞ্চলের সংগঠক পদে রয়েছেন ১৮ জন, যেমন আসাদুল্লাহ আল গালিব, রাসেল আহমেদ, মেহেরাব সিফাত, ইমরান ইমন, আবু সাঈদ লিওন, ফরহাদ সোহেল, রফিকুল ইসলাম আইনী, আজাদ খান ভাসানী, দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী, এস এম শোয়াইব, আব্দুল্লাহ আল মনসুর, মিয়াজ মেহরাব তালুকদার, মোস্তাক শিশির, নাহিদ উদ্দিন তারেক, শিরীন আক্তার শেলী, আবুল বাশার, আব্দুল্লাহ আল মুহিম এবং প্রীতম সোহাগ প্রমুখ।
দলে মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে আছেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, আর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুল হান্নান মাসউদ। এ ছাড়া যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কের পদে রয়েছেন আরও ১৪ জন, যাঁরা দলীয় কর্মকাণ্ডের সার্বিক সমন্বয়ের কাজ করবেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো: মো. তারিকুল ইসলাম (যুব), আব্দুল আহাদ, দিলশানা পারুল, আবু হানিফ, আব্দুজ জাহের, মাজহারুল ইসলাম ফকির, গোলাম মোর্তজা সেলিম, আশেকীন আলম, জাহিদুল বারী, কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস, ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু, শেখ মোহাম্মদ শাহ মঈনুদ্দিন, মারজুক আহমেদ ও সাদ্দাম হোসেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গণ-অভ্যুত্থানে নিহত-আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা। এতে তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং ভবিষ্যতে দলকে জনসম্পৃক্ত রাখতে এক সেতুবন্ধ রচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দলটির সদস্য পদে রাখা হয়েছে মোট ৪৩ জনকে, যেখানে শহীদদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। যেমন শহীদ জাবিরের বাবা কবির হোসেন, শহীদ আহনাফের মা জারতাজ পারভিন ছাড়াও খোকন চন্দ্র বর্মন (আহত), মো. দুলাল খান (আহত) প্রমুখ অনেকেই এতে অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও সাধারণ মানুষেরাও সদস্য হিসেবে দলে জায়গা পেয়েছেন।
গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে যে তরুণ-তরুণীরা, তাদের হাত ধরেই জাতীয় নাগরিক পার্টি ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথে পা বাড়াল। স্বাধীনভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে এ দলটি চাইছে, যাতে সব স্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
১. গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়বিচার: দলের প্রধান লক্ষ্য সংবিধান ও আইনকে কার্যকর করে জনসাধারণের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা।
২. আধুনিক ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব: তরুণরা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও স্বজনপ্রীতি থেকে দলকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
৩. জনসম্পৃক্ত কার্যক্রম: শহীদ ও আহতদের স্বজনদের সম্পৃক্ততা ভবিষ্যতেও জনসমর্থন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
4. বহুত্ববাদ ও ঐক্যের চেতনা: দলটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এত বড় পরিসরের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, তাও আবার গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে থাকা তরুণদের হাত ধরে—বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা। জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়ে দিল যে তারা প্রথাগত রাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে বদ্ধপরিকর।