Home আন্তর্জাতিক আফ্রিকা পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে নতুন মহাসাগর: আমেরিকার কাছে, তবে অদ্ভুত

পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে নতুন মহাসাগর: আমেরিকার কাছে, তবে অদ্ভুত

Posted by on in আন্তর্জাতিক 0
1st Image

আফ্রিকা মহাদেশে এখন এমন এক ভূতাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটছে, যা ভবিষ্যতে বিশ্বমানচিত্রে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষকদের অনুমান, আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলের আফার ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় বিদ্যমান ফাটল থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন মহাসাগর সৃষ্টি হতে পারে—যা প্রায় পাঁচ থেকে দশ মিলিয়ন বছরের মধ্যে আমেরিকার সীমানার কাছাকাছি এসে পৌঁছাতে পারে। এই বিরল ঘটনাটি টেকটোনিক প্লেটের ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার প্রত্যক্ষ ফল, যেখানে পূর্ব আফ্রিকা ধীরে ধীরে মূল মহাদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

টেকটোনিক সংঘর্ষ ও আফ্রিকা পুনর্গঠন

আফার ট্রায়াঙ্গেল হলো এমন একটি ভূখণ্ড যেখানে তিনটি টেকটোনিক প্লেট—নুবিয়ান, সোমালি ও আরবীয়—একত্রে মিলিত হয়েছে। এটি পূর্ব আফ্রিকান রিফ্ট সিস্টেমের অংশ, যা আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই রিফ্টিং বা ভাঙন প্রক্রিয়া চললেও, ২০০৫ সালে ইথিওপিয়ার মরুভূমিতে হঠাৎ ৩৫ মাইল দীর্ঘ ফাটল দেখা দিলে বিশ্বজুড়ে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। সোমালি প্লেট ধীরে ধীরে নুবিয়ান প্লেট থেকে সরে গিয়ে পৃথিবীর ভূত্বককে প্রসারিত করছে। একসময় লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের জল এই ফাটলে ঢুকে পড়ে নতুন মহাসাগরীয় অববাহিকা তৈরি করবে। এর ফলস্বরূপ সোমালিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও তানজানিয়ার কিছু অংশ মূল আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা ভূখণ্ডে রূপান্তরিত হতে পারে। উদীয়মান এই জলভাগ শুধুই আফ্রিকার ভূগোলকে নয়, বরং এর ভূ-রাজনীতি ও পরিবেশগত ভবিষ্যতকেও আমূল বদলে দেবে।

এর্টা আলে: আগামীর ভূতাত্ত্বিক জানালা

রিফ্টিং মূলত ঘটে যখন টেকটোনিক বল পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার (ভূত্বক ও উর্ধ্ব ম্যান্টল) ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং সেটি বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করে। এর ফলে গঠিত হয় রিফ্ট ভ্যালি, যেখানে নিম্নাঞ্চল (গ্রাবেন) এবং সামান্য উঁচু অঞ্চল (হরস্ট) পরস্পর সীমানা গড়ে তোলে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আফ্রিকার এই ভাঙন প্রক্রিয়ার অন্যতম চালিকাশক্তি হলো ম্যান্টল থেকে উঠে আসা অত্যন্ত উত্তপ্ত শিলা বা ম্যাগমার স্থিতিশীল স্রোত। এই স্রোত ভূত্বকের ওপর চাপ তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ফাটলের বিস্তার বাড়ায় এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতকে ত্বরান্বিত করে।

ইথিওপিয়ার এর্টা আলে আগ্নেয়গিরি, বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় লাভা হ্রদের আবাস, রিফ্টিং অঞ্চল বা সমুদ্রের মাঝখানে উপস্থিত ‘মিড-ওশান রিজ’-এর মতো ভূপ্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অগ্রসর প্রযুক্তি, যেমন জিপিএস ডিভাইস ও স্যাটেলাইট রাডার ব্যবহার করে ভূবিজ্ঞানীরা এখন মাটির নড়াচড়া ও পরিবর্তন অবিশ্বাস্য নির্ভুলতায় পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন। এসব ডেটা দেখাচ্ছে যে আরবীয় প্লেট প্রায় প্রতিবছর ১ ইঞ্চি গতিতে আফ্রিকা থেকে সরে যাচ্ছে, আর আফ্রিকার দুই প্লেট (নুবিয়ান ও সোমালি) অপেক্ষাকৃত কম গতিতে (প্রতি বছর ০.২ থেকে ০.৫ ইঞ্চি) বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মানুষের সময়ের হিসাবে এটিকে ধীর মনে হলেও এটি অবধারিতভাবে মহাদেশটির বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়।

বিভক্তি ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ

নতুন মহাসাগর সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘমেয়াদী হলেও, এটি মানুষের জনবিন্যাস ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিকভাবে কখন এবং কী পদ্ধতিতে এই বিভাজন পূর্ণতা পাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা একমত যে ফাটলের আশপাশে বসবাসকারীরা ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত ও ভূমিক্ষয়ের মতো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি অনুযায়ী, বর্তমানে পরিবেশগত পরিবর্তন ও জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে আফ্রিকায় অন্তত ১৫ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। সোমালি ও নুবিয়ান প্লেটের ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা অব্যাহত থাকলে, এই সংখ্যাও বাড়তে পারে। ভূমি অসম্পূর্ণ বা প্লাবিত হয়ে পড়লে মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে অন্য অঞ্চলে সরে যেতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা সমগ্র মহাদেশের জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

অন্যদিকে, নতুন মহাসাগর আবির্ভাবের ফলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। আজ যেসব দেশ স্থলবেষ্টিত—যেমন উগান্ডা ও জাম্বিয়া—ভবিষ্যতে সমুদ্রসীমার কাছাকাছি চলে আসতে পারে। এর ফলে বাণিজ্য ও যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। নতুন বন্দর, মাছ ধরার ক্ষেত্র ও সামুদ্রিক তলদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে এই অঞ্চলগুলো শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশে আরও গতিশীলতা অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং মহাসাগরীয় বিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণায়ও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

মহাদেশ ভাগ হওয়ার ইঙ্গিত ও ভবিষ্যতের রূপরেখা

আফার ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলে পৃথিবীর প্রাচীন ফসিলের ভাণ্ডার আছে, যা মানব-অগ্রজদের ইতিহাস জানতে সহায়ক। সেখানকার ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ ভবিষ্যতে পৃথিবীর ভূচিত্র ও বাস্তুসংস্থান কীভাবে রূপান্তরিত হতে পারে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। টেকটোনিক প্লেটের ধীরগতির এই চলাচল আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর ভূখণ্ড কখনো থেমে থাকে না—এটি অবিরাম পরিবর্তনের মধ্যেই রয়েছে।

যদিও পূর্ব আফ্রিকায় এই অখণ্ড মহাদেশ বিভাজিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখনো মিলিয়ন বছর দূরের ব্যাপার, তবু ভূতাত্ত্বিক ঘটনাগুলোর পর্যবেক্ষণ আমাদের ধারণা দেয় কীভাবে ভবিষ্যতে নতুন ভূখণ্ড বা মহাসাগরের জন্ম হবে। আফার ট্রায়াঙ্গেল এই অবিরাম রূপান্তরেরই প্রতীক, যা পৃথিবীর মানচিত্রকে পুনর্গঠন করে, বাস্তুতন্ত্র বদলে দেয় এবং সভ্যতার বিকাশে নবতর মাত্রা যোগ করে। ছয় নম্বর মহাসাগরের জন্ম হতে পারে মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি—যেমন অতীতে বরফযুগের রাস্তায় এত মানুষের ভ্রমণ ঘটেছিল, ঠিক তেমনি এই মহাসাগরও ভূ-রাজনীতি ও পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে।

 

সূত্র : ecoticias