পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও বন্ধ হয়নি ব্যবহার
বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার ও কেনাবেচা বন্ধ হয়নি। জনসচেতনতা কার্যক্রম ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান চললেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। এর ফলে পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এবং সরকারের উদ্যোগগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
পলিথিন নিষিদ্ধের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি
২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ আইন প্রণয়ন করেছিল, যা তখন বিশ্বে প্রথম নজিরবিহীন উদ্যোগ। প্রথমদিকে এই আইন কার্যকর হলেও নজরদারির অভাবে ২০০৬ সাল থেকে পলিথিন আবারও বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। গত ১৫ বছরে এটি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকায় পরিবেশের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলছে।
দৈনিক উৎপাদন ও দূষণ
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি পলিথিন বর্জ্য তৈরি হয়। প্যাকেজিং ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য এই সংখ্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এসডোর গবেষণা দেখায়, প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা বিষাক্ত রাসায়নিকের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
আইন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন মনে করেন, পলিথিনের বিস্তার মূলত আইনের প্রয়োগে ঘাটতির কারণে। তিনি বলেন, “আইন প্রয়োগে বাধা দেওয়া রাজনৈতিকভাবে সরকারের ব্যর্থতার ইঙ্গিত করে। মাঠপর্যায়ের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।”
অভিযান ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম
পরিবেশ অধিদপ্তর পলিথিনবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। পুরান ঢাকায় ২০২২ সালের একটি অভিযানে শ্রমিক-মালিকদের প্রতিরোধের মুখে অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য হয় কর্মকর্তারা। গতকাল রাজধানীর হাতিরপুল ও পলাশী কাঁচাবাজারে পরিবেশ অধিদপ্তর সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, “আমরা দুই ভাগে অভিযান চালাচ্ছি—সচেতনতা এবং মোবাইল কোর্ট। জনগণকে সচেতন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। শিগগিরই এর ফল পাওয়া যাবে।”
বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা
২০১০ সালে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের আইন প্রণয়ন করা হলেও সহজলভ্য বিকল্পের অভাবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ভোক্তারা এবং বিক্রেতারা সহজলভ্য বিকল্পের অভাবের কথা উল্লেখ করেন।
হাতিরপুল বাজারের গৃহবধূ নাজমুন্নাহার বলেন, “মাছ-মাংস পলিথিন ছাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। পলিথিন কোম্পানি বন্ধ না করলে আমাদের পলিথিন ব্যবহারে বাধ্য হতে হবে।”
সমাধানের প্রস্তাব
ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান মনে করেন, পলিথিন নির্মাণের কাঁচামালের আমদানি বন্ধ করা এবং উৎপাদন ও পাইকারি বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ করলেই দ্রুত এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
এসডোর গবেষণায় উঠে এসেছে, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে নির্গত রাসায়নিকের কারণে হাঁপানি, হৃদ্রোগ, ফুসফুসের সমস্যা ও চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ঢাকার মানুষ প্রতি মাসে ওষুধ ও চিকিৎসায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করছে, যা পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যার আর্থিক মূল্য।
পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি উৎপাদন ও সরবরাহ চক্র ভেঙে দেওয়া ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।