বর্তমান শাসনামলে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে, অন্তত ১২টি ব্যাংকে অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী ঋণের নামে এই বিপুল অর্থ সরিয়ে নিয়েছে। ফলাফলস্বরূপ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো চরম তারল্য সংকটে পড়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সহায়তা ছাড়া কার্যত টিকে থাকা সম্ভব হতো না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় মিলিয়ে মোট ১১টি ব্যাংককে জামানতবিহীন ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়, যার পরিমাণ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এত বড় সহায়তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি এখনো অনিশ্চিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের সভা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কীভাবে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং বর্তমানে তারা কী অবস্থায় আছে—সে বিষয়গুলো আজ (সোমবার) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তুলে ধরা হবে।
সহায়তা নেওয়া প্রধান ব্যাংকসমূহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১১টি ব্যাংক এই বিশেষ সহায়তা পেয়েছে:
সহায়তাপ্রাপ্ত ১১ ব্যাংকের তালিকা | |
---|---|
নং | ব্যাংকের নাম |
১ | ইসলামী ব্যাংক |
২ | ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক |
৩ | সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক |
৪ | ইউনিয়ন ব্যাংক |
৫ | গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক |
৬ | আইসিবি ইসলামী ব্যাংক |
৭ | এক্সিম ব্যাংক |
৮ | ন্যাশনাল ব্যাংক |
৯ | পদ্মা ব্যাংক |
১০ | বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক |
১১ | এবি ব্যাংক |
এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক সরাসরি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত সরকার পতনের পর সেগুলো তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়।
লুকানো ক্ষত ও ২০২২ সালের উন্মোচন
গত সরকারের সময় ব্যাংক খাতের নানা সমস্যাকে আড়াল করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ২০২২ সালের শেষদিকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয় গণমাধ্যমে এলে গ্রাহকেরা একযোগে টাকা তোলায় এই ব্যাংকগুলো প্রবল তারল্য সংকটে পড়ে। এমনকি বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) ও সরকারি সিকিউরিটিজ (এসএলআর) সংরক্ষণেও তারা ব্যর্থ হতে থাকে। এরপরেও তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে একটি চলতি হিসাব থাকে, যার মাধ্যমে সমস্ত আন্তঃব্যাংক লেনদেন এবং পুনঃঅর্থায়ন করা হয়। সাধারণত সিআরআর ও এসএলআরে ঘাটতি দেখা দিলেও চলতি হিসাবে ঋণাত্মক ভারসাম্য থাকার কথা নয়। কিন্তু ঐ সময় শরিয়াহ্ভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে চলতি হিসাব ঋণাত্মক রেখেও লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়, যা বেআইনি হলেও তৎকালীন গভর্নরের ‘বিশেষ অনুমোদনে’ বহাল থাকে।
নতুন গভর্নরের পদক্ষেপ ও বাস্তবতা
সরকার পরিবর্তনের পর, নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বেআইনি সব সুবিধা বন্ধের প্রয়াস নেন ও “টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া” পদ্ধতিও রহিত করতে চান। কিন্তু ব্যাংকগুলো এত বেশি সংকটে ছিল যে, এই কঠোর অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি। কারণ, টাকা ছাপিয়ে বা চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণ ছাড়া গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছিল অনেক ব্যাংক। শাখায় শাখায় অস্থিরতা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও টাকা ছাপিয়ে কিংবা গ্যারান্টির ভিত্তিতে তাদের ঘাটতি মেটানোর সুযোগ দেয়।
ব্যাংক খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, অতীতে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী চক্র শাসনমঞ্চের সহায়তায় ব্যাংক খাতে এই অনিয়ম করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাও এতে জড়িত ছিলেন। এখন ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই টাকা ধার দিতে হচ্ছে, যার ফেরত আসার নিশ্চয়তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত সবার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ব্যাংকগুলোকে সহায়তা প্রদানের ধরন
বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত তিনটি পদ্ধতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে:
১. সরাসরি টাকা ছাপিয়ে
২. ভালো ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে
৩. চলতি হিসাবে ঘাটতি মেনে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে
উপাত্ত অনুযায়ী, ২৭ হাজার ৪১০ কোটি টাকা ছাপিয়ে, ১৮ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা চলতি হিসাব ঘাটতি মেনে এবং গ্যারান্টির আওতায় ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘাটতি-আওতাধীন সহায়তা (১৮ হাজার ৩৩৪ কোটি) পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে অনুমোদিত হয়।
ব্যাংকওয়ারি পাওনার চিত্র
নিচের সারণিতে কোন ব্যাংক কী পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
(টাকার অঙ্ক ‘কোটি’তে দেখানো হয়েছে):
ব্যাংকের নাম | চলতি হিসাবে ঘাটতি | গ্যারান্টির আওতায় | টাকা ছাপিয়ে |
---|---|---|---|
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক | ৭,২৭০ | ১,০৫০ | ৫,৫০০ |
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক | ৩,৩৯৮ | ১,১৭৫ | ৪,০০০ |
ন্যাশনাল ব্যাংক | ২,৩৭০ | ৯৮৫ | ৫,০০০ |
ইসলামী ব্যাংক | ২,৩০৮ | ২,৩৯৫ | — |
ইউনিয়ন ব্যাংক | ২,২০৯ | ৪০০ | ২,০০০ |
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক | ৪০৬ | — | ২০০ |
পদ্মা ব্যাংক | ২৩৫ | — | — |
আইসিবি ইসলামী ব্যাংক | ৯৭ | — | ১০ |
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক | ৪১ | ২৯৫ | ২,০০০ |
এক্সিম ব্যাংক | — | ১,০৫০ | ৮,৫০০ |
এবি ব্যাংক | — | — | ২০০ |
টীকা: ‘—’ চিহ্নিত স্থানে কোনো তারল্য সহায়তা নেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যত ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ইতিমধ্যে অনেকগুলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি ব্যাংকগুলো সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তিনি জানান।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; যারা অনিয়মে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে কাজ করতে হবে। অন্যথায়, ব্যাংক খাতে লুটপাট ও অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।