রাজনৈতিক পালাবদলের পর, দেশের ব্যাংকিং খাতে নানা সংকটের মাঝে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। অতীতে অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো এখন ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের দিকে এগোচ্ছে। সম্প্রতি, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়ে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বাড়াতে কাজ করছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে সুদের হার সমন্বয়, রিজার্ভ সুরক্ষা, আমদানি বাণিজ্যে গতিশীলতা আনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং খাত পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ৮ আগস্ট। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই, ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। পাশাপাশি, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা নির্ধারণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যা দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত মান নির্ধারণ এবং আর্থিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য, ইউসিবি (ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক) এর পুনর্গঠনে সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই, ইউসিবি তার শক্তিশালী অবস্থানে ফিরে এসেছে। মাত্র দেড় মাসে, ইউসিবির সকল শাখা, উপশাখা, এজেন্ট আউটলেট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এক লক্ষেরও বেশি নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, যা গ্রাহকদের আস্থার প্রতিফলন। বিশেষত, ব্যক্তি শ্রেণি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই ব্যাংকের প্রতি আস্থা বাড়ছে, যা একটি ইতিবাচক সূচক। ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ বলেছেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর উদ্যোগের ফলে মানুষ আবার ব্যাংকের প্রতি ভরসা করতে শুরু করেছে। আমানত এবং ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং শক্তির প্রতীক।"
এছাড়া, সোনালী ব্যাংকেও বেশ উন্নতি দেখা গেছে, বিশেষ করে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর। সোনালী ব্যাংক এখন একটি স্থিতিশীল ব্যাংক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আমানতকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৪ সালে পরিচালন মুনাফায় সোনালী ব্যাংক শীর্ষে ছিল। এই ব্যাংকটি বড় কোনো অর্থায়ন না করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং রপ্তানি পণ্য উৎপাদনকারীদের ঋণ দিয়েছে, যার ফলে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় এখনো সোনালী ব্যাংককে বহন করতে হচ্ছে। গত ছয় মাসে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে ফিরে এসেছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেছেন, "সংস্কারের ফলে ব্যাংকিং খাত দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যে ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে ছিল, সেগুলোও এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।" এই মন্তব্যটি ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যতের জন্য একটি আশাবাদী বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এভাবে, দেশের ব্যাংকিং খাতের পুনরুদ্ধার, যা অতীতে নানা সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, এখন দৃশ্যমান সাফল্যের দিকে এগোচ্ছে। যদিও পুরোনো কিছু সমস্যার সমাধান এখনও পুরোপুরি হয়নি, তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।