Home অর্থনীতি কয়েকটা ব্যাংক বাঁচানো যাবে না: গভর্নর

কয়েকটা ব্যাংক বাঁচানো যাবে না: গভর্নর

Posted by on in অর্থনীতি 0
1st Image

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গভীর সংকটে রয়েছে। এই সংকটের মূল কারণ হলো সুশাসনের অভাব, অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা। সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অর্থনীতির পুনর্গঠন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক কর্মশালায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

এই কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এবং আরও অন্যান্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা অংশগ্রহণ করেন। ব্যাংক খাতের এই সংকট নিয়ে তাদের মতামত ও পরামর্শ এক গভীর বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, কিছু ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এতই বেশি যে, সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষত, কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের হার ৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। তিনি আরও উল্লেখ করেন, "একটি পরিবারের আধিপত্যের কারণে ব্যাংক খাতকে লুট করা হয়েছে, যেখানে ১০০ টাকার মধ্যে ৮৭ টাকা এক পরিবারকেই দেওয়া হয়েছে।"

এটি শুধুমাত্র সুশাসনের অভাবকেই প্রকাশ করে না, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকেও চিহ্নিত করে। এ ধরনের একপাক্ষিক ঋণ প্রদান আর্থিক ব্যবস্থায় অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করে এবং সঠিক ঋণ পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংকট কাটিয়ে উঠতে "ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট" প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের ব্যাংকের উপর নজরদারি বাড়ানো হবে এবং সুশাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। 

গভর্নর তার বক্তব্যে বলেন, "আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) যাতে ব্যাংকিং খাতে কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেজন্য নতুন নিয়মকানুন তৈরি করা হচ্ছে।"

এই উদ্যোগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে এনে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে কঠোর নিয়ম বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্তির উপর।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকিং খাতের সংকটের জন্য শুধুমাত্র সুশাসনের অভাব নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাবকেও দায়ী করেন। তিনি উল্লেখ করেন, "যাদের কাছে অভিযোগ করি, তারাই লুণ্ঠনে ব্যস্ত। গত ২০-২৫ বছর ধরে এ চিত্র দেখছি।"

তিনি আরও বলেন, "অর্থনীতিবিদরা শুধু ব্যাংক বন্ধ করার পরামর্শ দেন, অথচ ব্যাংক বন্ধ করলে পুরো অর্থনীতিই বন্ধ হয়ে যাবে।" তার মতে, ব্যাংক খাতের সংস্কার রাজনৈতিক সংস্কারের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এছাড়া, মিন্টু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন: "ব্যাংকগুলো শর্টটার্ম সঞ্চয়ের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত পুঁজিবাজার ঠিক না হবে, ততদিন এই খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হবে না।"

মিন্টু মনে করেন, শুধু অর্থনৈতিক নীতি বা আইনের পরিবর্তন করলেই ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সমাধান হবে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কারও প্রয়োজন। তার মতে, "যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক সংস্কার না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধি কোনোটাই সঠিকভাবে এগোবে না।"

এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাবের গভীরতা ও তার বিরূপ প্রভাবকেই তুলে ধরে। তার বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা না গেলে ব্যাংকিং খাতের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে।

ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করে সুশাসন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, এই আইনের কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তির কথা বলা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, "শুধু আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না, বরং তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাও জরুরি।" এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটময় সময় পার করছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সুশাসনের ফিরিয়ে আনা, রাজনৈতিক প্রভাব কমানো, এবং ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্টের কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। 

এর পাশাপাশি, পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, "পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি আনতে পারলেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধান হবে।"